33 C
Kolkata

চরিত্র বদল কলকাতার খানাপিনার

জয়ন্ত চক্রবর্তী : কলকাতার খাওয়া দাওয়ার সংস্কৃতিটা কেমন যেন বদলে গেল। মাত্র দু আড়াই দশকের মধ্যে কলকাতার কালিনারি কালচারের কি বিষম না পরিবর্তন! আজ অতীতের পৃষ্ঠায় ফিরে দেখি সেই নস্ট্যালজিয়াকে। প্রতিটি পাড়ায় সেই সময় একটি করে কেবিন থাকত।

শ্যামলি কেবিন, বাসন্তি কেবিন কিংবা এভারগ্রীন কেবিন। রেস্তোরাগুলির নামের সঙ্গে কিভাবে কেবিন শব্দটি সম্পৃক্ত হয়েছিল তা জানা নেই, কিন্তু এই কেবিনগুলিই ছিল তখন বাঙালীর আদি অকৃত্রিম ইটারি। সকালবেলা ধোঁয়া ওঠা চা, কালো গোলমরিচ দেওয়া টোস্ট আর ওমলেট। চারহাত ঘুরে আসা বাসি বিবর্ণ খবরের কাগজ। প্রায় মধ্যাহ্ন পর্যন্ত চায়ের কাপে তুফান।

তারপর দুপুরেই তালা পড়ে যেত এই কেবিনগুলোতে। আবার বিকেল বিকেল খুলত এই কেবিনের দরজা। মাটন চপ, ডিমের ডেভিল, ফিশ ফ্রাই ইত্যাদির গন্ধে মঁ মঁ করত পাড়া। এগুলি তখন পাড়ারই রেস্তোরা ছিল। বাঘবাজারের মাসিমা বাড়িতে অতিথি এলে বাড়ির ছোকরা খিদমদগার কে আদেশ করতেন, যা তো শ্যামলি কেবিন থেকে গরম গরম পাঁচটা ডেভিল নিয়ে আয়।

রাত আটটা পর্যন্ত এই চপ, কাটলেট, ফিশ ফ্রাই-এর কেবিন খোলা থাকত। হলুদ ষাট পাওয়ারের বাল্ব জ্বলত। সবুজ বনাত দেওয়া কাঠের টেবিলে নুনদানী আর মরিচদানীগুলি লট ক্লাইভের আমলকে মনে করিয়ে দিত। সাতের দশকে এই কেবিনগুলো আবার রাতারাতি ক্যাফে তে পরিণত হল। আমহার্স্টীটের কেষ্টবাবুর দোকানটির নাম হয়ে গেল কেষ্ট ক্যাফে। ঢাকুরিয়া ব্রীজের কাছে অনিল বাবুর দোকানটি হয়ে গেল ক্যাফে ডি ওনিল। এইসব ক্যাফের চরিত্র কিন্তু বদলালো না।

আরও পড়ুন:  Cooking tips: বাড়িতেই চটজলদি বানিয়ে ফেলুন ধনে পাতার মজাদার আচার!

সেই চপ, কাটলেট, ডিমের ডেভিলের সঙ্গে সাতের দশকে সংযোজন হল মোগলাই পরোঠার। ক্যাফেগুলিতে চলে এল কষা মাংস। সময়সীমাটি একটু বাড়ল। রাত নয়টা দশটা অবধি খোলা থাকত এই ক্যাফে গুলি। যোধপুর পার্কের বৌদি প্রায়শই রাতের রান্নার পাঠ শিকেয় তুলে ক্যাফে ডি ওনিল থেকে আনাতে লাগলেন কাষা মাংস মোগলাই পরোঠা। ইতিমধ্যে বাঙালীর খাবার জগতে শুরু হয়ে গিয়েছে আরেকটি বিপ্লব। রোল বিপ্লব। পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে রোল সেন্টার।

অর্থনীতিবীদরা বলে, বেকার সমস্যায় জর্জরিত বাংলা রোলের বিজনেস কে আঁকড়ে ধরেছিল আটের দশকের গোঁড়ায় । রোল যে এমন ভিনি, ভিডি, ভিসি হবে তা কেউ বোঝেনি। রোল এল, দেখল এবং জয করল। এগরোল, চিকেন রোল, ডাবল এগ রোল, এগ চিকেন রোল, এগ মাটন রোল। কতরকম নাম। নিরামিষ ভোজীরাও বা বাদ থাকেন কেন? তাদের জন্য এসে গেল পনীর টিক্কা রোল।

আটের দশকের মাঝামাঝি পার্কস্ট্রীটে শুরু হল হট কাটি রোল। রোলের ব্যবসার দুর্দান্ত রমরমা শুরু হল। যা চৈনিক বিপ্লবকেও প্রায় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল। কেষ্টবাবু বা ওনিল বাবুদের চ্যালেঞ্জ জানিযে সাতেক দশকের মাঝামাঝিতে কিন্তু এসে গেছে চীনা খাবার। যা এতদিন পর্যন্ত শুধু ট্যাংরায সীমাবদ্ধ ছিল, তা ছড়িযে পড়েছে গোটা কলকাতায় । বাঙালী অবশ্য তখনও চীনা খাবার বলতে বোঝে শুধু চিলি চিকেন আর চাউমিন। তারপর সেখানেও নানা পরিবর্তন এল।

আরও পড়ুন:  TMC vs BJP: নবজোয়ারের পথে এবার বঙ্গ বিজেপি ! নাম- জনসম্পর্ক অভিযান

বাঙালী যথার্থ ভোজনবিলাসী হযে উঠল। কিন্তু বাধ সাধলেন মার্কিন মুলুক থেকে আসা সেক্রেটরি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার। কলকাতায় এসে তিনি বাযনা ধরলেন বাঙালী খাবার খাওয়ার। আটের দশকে কোথায় ভজহরি মান্না কোথায় বা তেরো পার্বন বা কোথায় ষোলো আনা বাঙালীয়ানা। বাধ্য হয়ে রাজ্যের মুখ্যসচীব হেনরি কিসিঞ্জারকে সরষে ইলিশ খাওয়াতে নিয়ে গেলেন অধুনালিপ্ত শিযালদহের ব্যারনস হোটেলে।

কিসিঞ্জার চোখ খুলে দিলেন কলকাতায় বাঙালী রেস্তোরার অভাবের। কিন্তু বাঙালী বলে কথা! নয়ের দশকের মাঝামাঝিতে কলকাতা ছেয়ে গেল বাঙালী কালিনারি রেস্তোরায়। আগে যা ছিল পাইস হোটেলের সম্পদ, তাই এল অভিজাত বাঙালী রেস্তোরায়। বাঙালী রেস্তোরায় খেতে শিখল ইলিশ ভাপা কিংবা চিংড়ির মালাইকারী। একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আপ্তবাক্য, দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, স্মরণ করে কলকাতায় এসে গেল রুটি তড়কা, সাদা কিংবা মশলা দোসারা। বাঙালীর জিহ্বার রুচি বদলাল। সর্বভূক বাঙালীর নামটি স্বার্থক হল।

Featured article

%d bloggers like this: