নিজস্ব প্রতিবেদন: বারো মাসে তেরো পার্বণ৷ আর সেই তেরো পার্বণে হাজারও বারব্রত৷ পূর্ববঙ্গে এই রীতির কিছুটা ছাড়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মায়েরা নাছোড় এই বারব্রত পালনে৷ ঋতুর হাওয়াবদলের সঙ্গে সঙ্গে বর্ধমানের ঘরে ঘরে এই বাঙালিয়ানাটুকুকে সম্বল করে এখানকার মহিলারা বেশ হুল্লোড়ে থাকেন ওই দিনগুলোতে৷ যারা অফিস করেন তাঁরাও শুনি উপোসটুকুনি ছাড়তে নারাজ৷ ভোরবেলা ব্রতকথার বইখানিতে পেন্নাম ঠুকে কথকতায় চোখ বুলিয়ে তার পর দশটা -পাঁচটায় সামিল হন৷ সে দিন শিকেয় তোলা মাছের ঝোলভাত -ডাল -চচ্চড়ি৷ দুপুরে ফলাহার , রাতে ময়দার ভাজা সব সুস্বাদু৷
কাউকে আবার বলতে শুনেছি , মায়েদের মুখ বদলানোর সব উপায় করে দেওয়া হয়ে আসছে অনন্তকাল ধরে৷ কিন্ত্ত সত্যি কি তাই ? আসলে প্রতিটি ব্রতকথার আড়ালে যে ছোটো উপাখ্যানগুলি আছে সেগুলি প্রচলিত হলেও লোকশিক্ষার মোড়কে হাজির করা হয় আমাদের সামনে৷ আর বিশেষ দিনগুলি পালনের অর্থ হল সেগুলিকে বারবার নিজেদের সাংসারিক টানাপোড়েনে ঝালিয়ে নেওয়া৷ মনে মনে তাঁরা বলেন ” বারব্রত নিষ্ফল হয় না , ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই ” ।
জ্যৈষ্ঠের প্রতি মঙ্গলবারে কুমারী ও সধবারা সংসারের মঙ্গলকামনায় স্মরণ করেন মা মঙ্গলচণ্ডীকে৷ বর্ধমানের মায়েরা এই দিন কাঁঠালপাতায় দুব্বোঘাস , ধান , যব ও মুগকলাই রেখে খিলি বানিয়ে মা চণ্ডীকে নিবেদন করেন ও পরে কলার মধ্যে সেই ধান -যব পুরে ‘গদ ’ গিলে খান৷ আমলা বাটা আর হলুদ দিয়ে স্নান করানো হয় মা ’কে এবং পাঁচটি ফল দান করতে হয়৷
মঙ্গলচণ্ডীর এই ব্রতকথায় আছে , জয়দেব ও জয়াবতীর কথা৷ দেবীমাহাত্ম্য বিস্তারের জন্য স্বয়ং মা দুর্গাই বুড়ী ব্রাহ্মণীর বা দেবী ক্ষেমঙ্করীর বেশ ধরে মর্ত্যে চলেন৷ মহাবিদ্যা ধূমাবতীর ধনাত্মক রূপ দেবী ক্ষেমঙ্করী,এই দেবী গৃহী পুজ্য।
‘ মায়া করি ধরে মাতা জরাতীর বেশ ,
হাতে লাঠি কাঁধে ঝুলি উড়ি পড়ে কেশ ’ ৷
উজানীনগরে এক সওদাগরের বাড়িতে তিনি হাজির হন৷ প্রখর রোদে হঠাত্ গিয়ে ভিক্ষা চাইলেন৷ বেনেবউ থালায় করে চাল আর টাকা দিয়ে সিধে দিলেন৷ কিন্ত্ত ব্রাহ্মণীর সাতটি মেয়ে , একটিও পুত্র নেই৷ বুড়ি সেই শুনে আর ভিক্ষে নিলেন না৷ দিনে দুপুরে ভিক্ষা না নিয়ে চলে যাওয়ায় সংসারের অকল্যাণ হবে জেনে বেনেবউ কান্নায় ফেটে পড়লেন৷ এ দিকে সওদাগর খোঁজ করে সেই বুড়ির কাছে গেলেন৷ বুড়ি তার হাতে একটি ফুল দিয়ে বললে , সেই ফুলটি যদি তার বউ ধুয়ে জল খায় তবে সে সুপুত্রের জননী হবে৷ বুড়ো বয়সে বেনেবউ আবার গর্ভবতী হল৷ ফুটফুটে ছেলে হল তার৷ তার নাম রাখা হল জয়দেব৷ এ বার সেই ব্রাহ্মণী হাজির হল আর এক সওদাগরের গৃহে৷ তার সাতটি পুত্র, কন্যা নেই৷ তাই ভিক্ষে নিলেন না তাঁর ঘরে৷ এ বারে কারণ হল কন্যাসন্তানকে প্রাধান্য দেওয়া৷ ঠিক আগের মতোই এই গৃহেও ফুল ধোয়া জলপান করে গৃহিণীর কন্যাসন্তান হল৷ তার নাম রাখা হল জয়াবতী৷ পাশাপাশি দু’টি গ্রামে জয়দেব আর জয়াবতী বড়ো হয়৷
তারা খেলে বেড়ায় , আপনমনে ছেলেখেলার ছলে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করে৷ জয়দেবের বিশ্বাস নেই কিন্ত্ত জয়াবাতীর অগাধ বিশ্বাস৷ এ ভাবেই একদিন জয়দেবের পায়রা এসে বসে জয়াবতীর কোলে৷ জয়াবতী দিতে নারাজ৷ জয়দেব প্রশ্ন করে , সে কি পুজো করছে ? জয়াবতী বলে এই চণ্ডীপুজো করলে ‘হারালে পায় , মলে জিওয় খাঁড়ায় কাটে না৷ আগুনে জলে ফেলে দিলে মরণ ঘটে না৷ সতীন মেরে ঘর পায় , রাজা মেরে রাজ্য পায় ’৷
জয়দেবের তা শুনে ভালো লাগে৷ জয়াবতীকে সে বিয়ে করতে চায় , মা ’কে জানায়৷ জৈষ্ঠ্যমাসের মঙ্গলবারে তাদের বিয়ে হয়৷ সে দিন জয়াবতী আঁচল থেকে গদ বের করে গিলে খায়৷ এ বার জয়দেবের জয়াবতীকে পরখ করার পালা৷ অঢেল ধনরত্ন , গয়নাগাটি নিয়ে জয়াবতী জলপথে শ্বশুরঘরে যাত্রা করে৷ মাঝপথে জয়দেব জয়াবতীকে বলে ডাকাতের উপদ্রবের কথা৷ কাপড়ের পুঁটুলিতে সব গয়নাগাটি বেঁধে জয়দেব সেটিকে জলে ফেলে দেয়৷ জয়াবতী তা দেখে মা চণ্ডীকে স্মরণ করে৷ শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পর দিন বউভাতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য নদীতে জাল ফেলে যে মাছ ধরে আনা হয় সেই মাছ কাটতে গিয়ে লোকজন হিমশিম৷ বঁটি , দা , কুড়ুল কিছু দিয়েই সেই বোয়ালমাছটি কাটা যায় না৷ তখন জয়াবতীর ডাক পড়ে৷ জয়াবতী মা মঙ্গলচণ্ডীকে স্মরণ করে অতি অনায়াসেই বঁটিতে মাছের পেট কেটে ফেলে আর তার গয়নাশুদ্ধ পুঁটুলিটা পায়৷ তখন জয়দেবও বুঝতে পারে দেবী মাহাত্ম্য৷ তাই বুঝি মঙ্গলচণ্ডীর পুজোয় এখনও মেয়েরা আওড়ায় এই মন্ত্র ,
” আটকাটি ,
আটমুঠি সোনার মঙ্গলচণ্ডী রুপোর পা ,
কেন মাগো মঙ্গলচণ্ডী হল এত বেলা ?
হাসতে খেলতে ,
তেলহলুদ মাখতে ,
আঘাটায় ঘাট করতে ,
আইবুড়োর বিয়ে দিতে ,
অন্ধের চক্ষু দিতে ,
বোবার বোল ফোটাতে ,
ঘরের ঝি বৌ রাখতে ঢাকতে হল এত বেলা৷ ” –
এ ভাবেই সংসারের রমণীটি সংসারের সার্বিক সুখ শান্তি কামনা করে থাকে৷ আর একটা কারণ হল , গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুটিফাটা বাংলার মাঠঘাট৷ মা চণ্ডীর পুজোয় যদি সময়মতো বর্ষা নামে , তবে বাংলার কৃষিপ্রধান বর্ধমান জেলাটির শস্যভাণ্ডারটিও ফুলে ফেঁপে উঠবে সেই আশায় বুঝি মা চণ্ডীর শরণাপন্ন হওয়া৷
মা মঙ্গলচণ্ডী ব্রত :
জৈষ্ঠ্যমাসের প্রতি মঙ্গলবারে মা চণ্ডীর আরাধনা করা হয় বলে এ ব্রতের নাম মঙ্গলচণ্ডী ব্রত। জীবনে শ্রেষ্ঠ মাঙ্গল্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই এ ব্রতের অনুষ্ঠান। মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের নানা রূপ আছে। কুমারীরা যে মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের আচরণ করে, তা অতি সহজ ও সংক্ষিপ্ত। দেবী অপ্রাকৃত মহিমার প্রশস্তিগীতি ব্রতের ছড়ায় এসে ধরা দেয়।
রূপোর মা মঙ্গলচণ্ডী।।
এতক্ষণ গিয়েছিলেন না
কাহার বাড়ি?
হাসতে খেলতে তেল সিন্দুর মাখতে
পাটের শাড়ি পরতে সোনার দোলায় দুলতে
হয়েছে এত দেরী।
নির্ধনের ধন দিতে
কানায় নয়ন দিতে
নিপুত্রের পুত্র দিতে
খোঁড়ায় চলতে দিতে
হয়েছে এত দেরী।
অতি প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় সংসারের মঙ্গল কামনায় মহিলাগণ মঙ্গলচণ্ডীর পূজো করে থাকেন। পুরাণের দেবী চণ্ডী অস্ত্রধারিনী, অসুর মর্দিনী। কিন্তু মঙ্গলচণ্ডী দেবীর যে পট ছবি আমরা দেখি তাতে তিনি দ্বিভুজা, হাতে পদ্ম পুস্প, পদ্মাসীনা। সমগ্র মাতৃত্বের রূপ দেবীর মধ্যে প্রস্ফুটিত। চণ্ডীদেবীর কথা বৃহধর্ম পুরাণে পাওয়া যায়। ভবিষ্যপুরাণে মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে ইনি কেবল স্ত্রীলোকের দ্বারা পূজিতা বলা হয়েছে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য অনুসারে চন্ডীদেবীর আবির্ভাবের প্রথম পর্বে দেখি কালকেতু ও ফুল্লরার কথা। কালকেতু জাতিতে শবর ব্যাধ, তার পত্নী ফুল্লরা এক শবরী । কালকেতু বনে শিকার করে মাংস হাটে বিক্রি করে সংসার চালাতো। একদা দেবী চণ্ডী তাদের গৃহে ছদ্দবেশে এসে পরীক্ষা নেন। কালকেতু ও ফুল্লরাকে শেষে দশভুজা রূপে দর্শন দিয়ে তাঁদের গুজরাট প্রদেশের অধিপতি করেন।
মঙ্গলচণ্ডিকা পূজা মন্ত্র :
ওঁ হ্রীং শ্রীং ক্লীং সর্বপূজ্যে দেবী মঙ্গলচণ্ডিকে।
শিবশম্ভুপাঠকৃত মঙ্গলচণ্ডিকা স্তোত্র :
রক্ষ রক্ষ জগন্মাতর্দেবি মঙ্গলচণ্ডিকে।
হারিকে বিপদাং রাশর্হর্ষমঙ্গলচণ্ডিকে।।
হর্ষমঙ্গলদক্ষে চ র্হর্ষমঙ্গলচণ্ডিকে।
শুভে মঙ্গলদক্ষে চ শুভমঙ্গলচণ্ডিকে।।
মঙ্গলে মঙ্গলার্হে চ সর্ব্ব মঙ্গলমঙ্গলে।
সতাং মঙ্গলদে দেবি সর্বমঙ্গলালয়ে।।
পূজ্যা মঙ্গলবারে চ মঙ্গলাভীষ্টদৈবতে।
পূজ্যে মঙ্গলভূপস্য মনুবংশস্য সংততম্।।
মঙ্গলাধিষ্ঠাত্রীদেবি মঙ্গলানাং চ মঙ্গলে।
সংসার মঙ্গলাধারে মোক্ষমঙ্গলদায়িনি।।
সারে চ মঙ্গলাধারে পারে চ সর্বকর্মণাম্।
প্রতিমঙ্গলবারে চ পূজ্যে চ মঙ্গলপ্রদে।।