31 C
Kolkata

Satyajit vs Rittick: দুই-পার বাংলার টক্কর

নিজস্ব প্রতিবেদন : বাঙালির আড্ডা মানেই চা আর তর্ক। তা সে ইংলিশ চিংড়ি নিয়েই হোক, বা ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান আসর জমবে তর্কতেই। তবে সিনেপ্রেমীদের আরও একটি পছন্দের বিষয় সত্যজিৎ নাকি ঋত্বিক। আমার মনে আছে কলেজের একটা দিন, আমাদের এরকমই একটি ডিভেট প্রতিযোগিতা চলছে, বর্ষাকাল, আমরা সবাই তৈরি বর্ষাতে ইংলিশ না চিংড়ি এটাই বিষয় হবে। তবে ঘুরেফিরে আমাদের পাতে পড়ল সত্যজিৎ নাকি ঋত্বিক। সেখানে কিছু বলতে পারিনি, তারপর থেকেই চর্চা শুরু, দুজনের মধ্যে পার্থক্য কোনদিনও পাইনি, আবার তাঁদের মধ্যে পার্থক্য ছিল বিস্তর। চলচ্চিত্র জগতের দুজন মহারথী। দুজনেরই বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তবে আমার মনে হয় পশ্চিম বিশ্বে সত্যজিৎ রায়ের নামটা বেশ কিছুটা বেশি। তারা সত্যজিৎ-র সিনেমা দিয়ে ভারতের মানুষকে বুঝতে চান। এটা বুঝতে অসুবিধা নেই যে সত্যজিৎ-র সিনেমা মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তর গল্প বলে। সত্যজিতের তুলনায় ঋত্বিকের নাম পশ্চিমা বিশ্বে মৃদ কণ্ঠে উচ্চারিত হয়।ঋত্বিকের ছবি গল্প বলে মধ্যবিত্ত এবংনিম্ন মধ্যবিত্তর তবে তার সঙ্গেই রয়েছে আড়ম্বর আর হটকারীতা। কথা হলো পশ্চিমের দুনিয়া কাকে হিরো বানাল আর কাকে বানাল না, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানো খুব জরুরি না। আমাদের আত্মায় কার চলচ্চিত্র বাস করে, সেটাই আসল কথা? ঋত্বিক নাকি সত্যজিৎ এনাদের তুলনা করা খুব একটা যথাযথ বলে আমার মনে হয় না তবে যেখানে সত্যজিতের কথা উঠবে সেখানেই ঋত্বিক তো আসতে বাধ্য। যদি বলা হয় সত্যজিৎ-র ‘পথের পাঁচালী’ ইতিহাস তৈরি করে দিয়ে গেছে, তাহলে তার সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ই বা কম কি? সোজাসাপ্টা কথায় যদি দুজনের গল্প বাঁধনে পার্থক্য করতে চাই, তাহলে সত্যি বলতে কি ঋত্বিক ঘটকের গল্পে থাকে মানুষ, মানুষের চিৎকার, জয়জয়কার, দুঃখ একই সঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার। ঋত্বিক আপোসহীন, অপরদিকে সত্যজিৎ অনেক বেশী আপসকামী। তাঁর গল্পে রোমান্টিকতা, চলাফেরা, কথাবার্তা, আদব-কায়দাতেই আপামর বাঙালি কুপোকাত। মানে আরও সোজাসাপ্টা কথায় যদি আমি বলতে চাই সাহিত্যে যেভাবে রবীন্দ্রনাথ নিজের ভাবনা থেকে বুনে দিতেন সুন্দরভাবে বাংলা চলচ্চিত্রকে ঠিক সেই ভাবে বুনতেন সত্যজিৎ।

আরও পড়ুন:  Tollywood: প্রয়াত টলিপাড়ার কিংবদন্তী বর্ষীয়ান অভিনেতা

অপরদিকে বঙ্কিমকে বুঝতে যেমন বেগ পেতে হত ঠিক তেমনই ঋত্বিকের গল্পের ভিতরের মানে বুঝতে বেগ পেতে হয়। তবে ওই যে প্রথমেই বললাম দুজনে আলাদা হলেও কোথাও গিয়ে দুজনেই সমান। ঋত্বিক ঘটক প্রতিবাদ করতেন সরাসরি।সেই সময়ের সমাজের বাস্তব পটভূমিকেই তুলে ধরতেন নিজের ছবিতে।যেমন ধরুন, নাগরিক অধিকার, শ্রমজীবী আন্দোলন। আবার এদিকে সত্যজিৎ অনেক বেশি ইরোনিকালি ছবি বানাতেন। তিনি সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতির কথা না বললেও রূপকের সাহায্যে সমাজ ব্যবস্থাকে বিদ্রূপ করতেন। সত্যজিৎ নিজেও বলে গেছেন “ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তার সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। ” ঋত্বিক কতটা তীব্রভাবে বাঙালি ছিলেন, ঋত্বিক কতখানি নিবিড়ভাবে বাংলার মানুষের ছিলেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সত্যজিৎ রায়ের এই অকপট সাক্ষ্য। বহু প্রেম আর বহু জন্মের নির্বাক সাক্ষী পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনে জন্ম হয় যমজ ভাই-বোন, ঋত্বিক-প্রতীতির। তাঁদের ডাকনাম ছিল ভবা আর ভবী। ঋত্বিকের পুরো নাম ঋত্বিক কুমার ঘটকএছাড়াও সত্যজিৎ আর্থিক দিক থেকেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছিলেন, ঋত্বিক যে তা পাননি। নাগরিকের ছয় বছর পর ১৯৫৭ তৈরি হয় ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’, যা মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। ছবির নায়ক ড্রাইভার এবং নায়িকা তার গাড়ি। ‘অযান্ত্রিক’ এর গল্প এগিয়ে গেছে এভাবেই। সেসময় পুরো ভারত জুড়েই অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করে ছিলো ছবিটি। অযান্ত্রিক প্রসঙ্গে আরেক জ্বল জ্বলে তারা সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,‘ঋত্বিক ঘটকের দ্বিতীয় ছবি অযান্ত্রিক যারা দেখেছিলেন,তারা ঋত্বিকের অসামান্য বৈশিষ্ট ও মৌলিকতার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন’।

আরও পড়ুন:  Asis Vidyarthi: ৬০ বছরে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে আশিস বিদ্যার্থীর

ছোট থেকে নাটক জগতের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকার দরুন মাঝেই মাঝেই এনাদের গল্প শুনতাম। একবার এইরকমই খ্যাপা ভবার (ঋত্বিক ঘটক) গল্প শুনতে শুনতে জেনেছিলাম ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় নিজের জন্মভিটে ছেড়ে রিফিউজি হতে হয় ঋত্বিককে। বাংলা ভাগের এই ব্যাথাই শান্তিতে থাকতে দেয়নি ঋত্বিক ঘটককে। “ওপারেই আমার দেশের বাড়ি। ওই যে ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে, এত কাছে। অথচ কোনও দিন আমি ওখানে পৌঁছতে পারব না। ওটা বিদেশ…” দেশভাগের কঠোর যন্ত্রণা ধরা পড়েছে তাঁর একের পর এক কাজে। কাউকে এপার বাংলা বলতে শুনলে চেঁচিয়ে উঠতেন, বাংলার আবার এপার-ওপার কী”! আর তাঁর এই কষ্ট অনুমান করতে কষ্ট হয়না তাঁর পরিচালিত সিনেমা গুলি দেখার পর। আর তাঁদের এই পার্থক্যে অনেকটা বেশি দায়ী তাঁদের ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্দেশনার পিছনে।

Featured article

%d bloggers like this: